ডেঙ্গুতে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু, সরকারি অবহেলার পরিণতি বলছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা
ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। চলতি নভেম্বর মাসের শুরু থেকেই প্রতিদিন ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে শুরু করে আজ বুধবার সকাল আটটা পর্যন্ত) দেশে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১০ জন। একদিনে চলত বছর এটি সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে ডেঙ্গুতে ১২ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছিল। তবে সেই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, এর মধ্যে তিনটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল আগের দিন অর্থাৎ ২০ সেপ্টেম্বর। সেই হিসেবে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে এডিস মশা কামড় হওয়া ডেঙ্গু রোগে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেলেন। আর এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে ৩০২ জন।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলছিলেন, প্রতিটি মৃত্যু ছিল প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ না করে গতানুগতিক পন্থা অবলম্বর করাতেই এই মৃত্যু হলো। এটা খুবই দুঃখজনক। সরকারকে বারংবার এ বিষয়ে সাবধান করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কোনো বোধোদয় হয়নি। এসব মৃত্যু তাই সরকারি অবহেলার পরিণতি ছাড়া অন্য কিছু নয়।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৬৯ জন। এ নিয়ে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা হলো ৭৪ হাজার ৯৯২ জন।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় পাঁচজনেরই মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এলাকায় থাকা হাসপাতালগুলোতে। এর মধ্যে তিনজন মারা গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আর দুজন ল্যাবএইড হাসপাতালে। ১০ জনের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন উত্তর সিটি করপোরেশনের হাসপাতালে। তাদের মধ্যে দুজন মারা গেছেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এবং একজন মারা গেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দুজনের মৃত্যু হয়েছে ভোলা ও খুলনায়। মোট আক্রান্তদের মধ্যে ৪০৮ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন। দুই সিটির বাইরে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায়, এ সংখ্যা ২১৪। ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছে গাজীপুর জেলায়, রোগী সংখ্যা ৬৫। চলতি বছরের শুরু থেকে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল যে বরিশাল বিভাগে সেখানে একদিনে রোগী হয়েছে ১২৮ জন। আর এ বিভাগের জেলায় বরগুনায় রোগী সংখ্যা ছিল ৪৭। এ বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে এ সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ।
চলতি বছরে যে ডেঙ্গুতে সংক্রমণ বাড়তে পারে, তার ইঙ্গিত শুরুতেই দিয়েছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। কিন্তু বিষয়টি আদৌ আমলে নেয়নি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো। জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়েছে। আবার তাপমাত্রাও ছিল এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধির সহায়ক। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ছিল চরম। আবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার সহায়তায়। দীর্ঘ সময় পর এসে গত অক্টোবর মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সতর্ক করে জানায়, জ্বর হলেই ডেঙ্গুর পরীক্ষা করতে হবে। এটুকু বলে মোটামুটি দায়িত্ব শেষ করেছে তারা। কিন্তু সহজে এবং কম খরচে ডেঙ্গুর পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়নি।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। এর দায়িত্ব মূলত পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকার পরিষদগুলোর। কিন্তু সরকার পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকার পরিষদগুলো ভেঙে দেয়। মশা নিয়ন্ত্রণে পৌরসভাগুলো যে খুব ভালো কাজ করত তা কেউই দাবি করেন না। কিন্তু জনস্বাস্থ্যবিদদের কথা, অন্তত সেখানে জনপ্রতিনিধি থাকলে কিছুটা হলেও মশা নিধনসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ হতো। কিন্তু পরিষদগুলো ভেঙে দিয়ে পুরো ব্যবস্থাপনা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বলেই মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
এর মধ্যে অক্টোবরের শেষে এবং চলতি মাসের শুরুতে বৃষ্টিপাত ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে একাধিক বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা করেছিলেন। এখন মাসের শুরু থেকে যে হারে রোগী বাড়ছে এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঘটছে তাতে এসব শঙ্কা এখন সত্যি হওয়ার পথে।

